১৯৩০ সাল। ভারতের
জাতির পিতা মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী ডাক দিলেন আইন অমান্য আন্দোলনের।
সবরমতী আশ্রম থেকে ডান্ডি পদযাত্রা শুরু করে ২৪ দিনে ২৪০ মাইল (৩৯০ কিলোমিটার) পথ
পায়ে হেঁটে ডান্ডি গ্রামে এসে বিনা-করে সমুদ্রের জল থেকে লবণ প্রস্তুত করেন।
বিরাট সংখ্যক ভারতীয় তার সঙ্গে ডান্ডিতে আসেন। ১৯৩০ সালের ৬ এপ্রিল সকাল সাড়ে
৬টার সময় গান্ধীজি লবণ আইন ভেঙে প্রথম লবণ প্রস্তুত করেছিলেন। সেই সঙ্গে তার
লক্ষাধিক অনুগামীও লবণ আইন ভেঙে ভারতে সূচনা করেন আইন অমান্য আন্দোলনের।
সেই আন্দোলনের
প্রভাব কি না কে জানে, বাঙালী বিশেষ করে বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে আইন না মানার যে
প্রবণতা, সেটা এখনও সর্বোচ্চ উত্তুঙ্গে বিরাজমান। কেউ আইন মানতে চায় না। আইন মানাটাকেই
এখন সবচে‘ বড় বেআইনি কাজ মনে হয়।
আপনি বৈধভাবে এই বাংলাদেশে সম্ভবত একটা কাজও করতে পারবেন না। একটা ন্যূনতম কোনো সরকারি সেবাও সততার সাথে আদায় করতে পারবেন না। উদাহরণ দিতে যাওয়াটা এখানে বোকামি, আগুনের ভেতরে বসে থাকা মানুষের জন্য আগুনের অস্তিত্ব নিয়ে আলোচনা অপ্রয়োজনীয়, বরং বিষয়টার গোড়ার দিকে তাকানোই ভালো।
ঘটনাপ্রবাহ-১
এক বন্ধু আসবে
ঢাকা থেকে, সস্ত্রীক। ঢাকায় ট্রেনের টিকিট কেটেছে, কিন্তু আপডাউন কাটতে পারেনি। আমি
গেলাম সিলেট থেকে তার ফেরার টিকিট কাটতে। যাবার আগে অনলাইনে চেক করলাম, যথারীতি দুদিন
আগে থেকেই সব টিকিট গায়েব। কোনো এক লিংকে ব্লাকমার্কেটের সন্ধান পাওয়া গেলো। সেই ভরসায়
গেলাম স্টেশনের দিকে। জায়গাটার বর্ণনা দিলে সিলেটবাসী অনেকেই চিনবেন, বলা সংগত বোধ
করছি না। লোকটা এক বাসের টিকিট কাউন্টারে বসে আছে। কথাবার্তা হলো, সে টিকিট ম্যানেজ
করে দিতে পারবে। তবে যে দাম হাঁকালো, সেটা নর্মাল টিকিটের দেড় গুণের চাইতে বেশি। দাম
শুনে একরকম হা হয়ে গেলাম।
ঢাকার বন্ধুর সাথে যোগাযোগ করলাম, সে এই দামেই নিবে। বিষয়টা কষ্টকর হলেও কিছু করার ছিলো না। বিকাশে টাকা আনিয়ে ক্যাশআউট করতে গেলাম।
ঘটনাপ্রবাহ-২
হঠাত করেই মারামারি
লেগে গেলো। এক সিএনজি ড্রাইভার, মিতালী পরিবহনের এক ড্রাইভারের মাথা বাঁশ ফাটিয়ে দিয়েছে।
বেচারা মাথায় হাত দিয়ে চরম উত্তেজিত হয়ে সিএনজি ড্রাইভারের সাথে মারামারি বাঁধিয়ে দিয়েছে।
আমার ব্ল্যাকমার্কেটার শুরুতেই মারামারির মাঝখানে চলে গেলো। বেশ কয়েকজন লোক মিলে মারামারি
থামানোর চেষ্টা করলো প্রথমে। কিন্তু পরক্ষণেই মিতালী পরিবহনের ড্রাইভার-হেল্পাররা
হৈচৈ করে বের হয়ে সেই সিএনজি ড্রাইভারকে স্টেশনের ভেতরে খোলা চত্বরে গিয়ে দুমিনিট রামধোলাই
দিয়ে দিলো।
সিএনজি ড্রাইভারও
বলশালী লোক। কোনোক্রমে মাঝখান থেকে পিছলে বেরিয়ে দৌড় দিলো স্টেশনে দাঁড়ানো অন্যান্য
সিএনজিগুলোর দিকে। খান ত্রিশেক সিএনজি, মানে ২৫-৩০ জন সিএনজিচালক। পরিস্থিতি তখন সমানসমান
হয়ে গেলো। আমি ভেতরে ঢোকার আগেই মিতালীর একজন কর্মী মাথা ফাটিয়ে রক্তাক্ত অবস্থায় বেরিয়ে
এলো।
খেলা জমে গেছে,
তেমন কেউ ভেতরে ঢুকছে না। হঠাত আমার মনে হলো, আমার যে টিকেটটা অনলাইনে চেক করেছি, ব্ল্যাকমার্কেটার
মিলিয়ে দিতে পারবে বলেছে, সেটা কাউন্টারে গিয়ে একবার চেক করি না কেন?
সাবধানে, পুরা
ফাইটিং মুড নিয়ে স্টেশনের ভেতরে ঢুকলাম। মাস্ক পরি না, কিন্তু পকেট থেকে মাস্ক বের
করে পরলাম। ভেতরে গিয়ে দেখি স্টেশনের গেইটে কড়া পাহারা। যাহোক, আমার তো ভেতরে যাবার
দরকার নেই। কাউন্টারে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, বৃহস্পতিবার সকালে কালনী এক্সপ্রেসের কোনো
টিকেট আছে কি না। চেক করে জানালো, শুধুমাত্র এসিবাথের টিকেট আছে, আর কিছু নেই।
অথচ, ব্ল্যাকমার্কেটার
আমাকে শোভন চেয়ার ম্যানেজ করে দিচ্ছে, নির্ঝঞ্ঝাট, টাকা ছাড়া কোনো কষ্টই নেই।
কাউন্টার থেকে
বের হয়ে গেলাম। স্টেশনের গেইটের দিকে এগুচ্ছি, তখন দেখলাম মিতালী পরিবহনের লোকজন ভালোরকমের
তাড়া খেয়েছে সিএনজি ড্রাইভারদের কাছে। কয়েকজন উত্তেজিত কণ্ঠে বললো- ‘রাস্তায় যতগুলা
সিএনজি পাও, সব ভেঙে ফেলো।‘
কয়েকজন হাতের
লাঠি দিয়ে সিএনজির হুডের মধ্যে বাড়ি দিতে লাগলো। পরিস্থিতি দেখে সিএনজি ড্রাইভাররা
দৌড় লাগালো গেইটের দিকে। আমিও ধীর পায়ে এগুলাম।
কাছে গিয়ে একদম হতবাক! চারটা সিএনজি দাঁড়িয়ে আছে। অবাক বিষয় যে, চারটা সিএনজির কোনোটারই গ্লাস ভাঙা নয়। অর্থাত, মিতালীর শ্রমিকরা শুধুমাত্র সিএনজির বডির ওপর লাঠিচার্জ করেছে, গ্লাসে নয়।
মোরাল:
এ থেকে আমি
এবং আমরা কী শিক্ষা নিতে পারি?
এটা বাস্তব
যে, উন্মত্ত জনতাকেও নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। পরিবহন শ্রমিকরা নিজেদের মধ্যে হয়তো এমন
কোনো চূক্তি তৈরি করেছে যে, তারা কোনো পরিস্থিতেই অন্যের গাড়ির গ্লাস ভাঙবে না, লাইট
ভাঙবে না, কোনো যাত্রীর গায়ে হাত তুলবে না। আমার চোখের সামনেই সেটা ঘটলো, দেখলাম।
কিন্তু এই মানুষগুলোই
দেশের আইন মানে না কেন? আমরাই বা মানি না কেন?
তাহলে এই যে আমাদের চিন্তা, বাঙালী আইন মানে না, আইন না মানা বাঙালীর রক্তে মিশে আছে, বিষয়টা কি আসলেই সত্যি? নাকি সময়ে সময়ে এদেশের সরকার, রাজনৈতিক দলগুলোই এই অরাজকতা টিকিয়ে রাখতে চায়? তারা চায় না, এদেশের মানুষ ভালো থাকুক, শান্তিতে থাকুক?
২.
সিঙ্গাপুর,
একটা পানির তলায় মিশে থাকা, পরিত্যক্ত দ্বীপ ছিলো। আজ কঠোর শাসনে, দুর্নীতির বিরুদ্ধে
আপোষহীন অবস্থানের কল্যাণে বিশ্বের সবচে‘ শক্তিশালী অর্থনীতির একটা দেশে আজ পরিণত হয়েছে।
অথচ আমাদের দেশে, যেই খাটের তলা থেকে টাকার বস্তা বেরুতে আরম্ভ হলো, অমনি হাজার হাজার
কোটি টাকা পাঁচার হয়ে গেলো সুইস ব্যাংকে।
আপনি ক্ষুদ্র
ব্যবসায়ী, আপনি অসুস্থ হয়ে বিদেশে চিকিতসা করাতে গেছেন, জরুরি প্রয়োজনে দেশ থেকে টাকা
আনাতে চান, কিন্তু আপনার জন্য সহজ কোনো সিস্টেম নেই। কিন্তু হাজার হাজার কোটি টাকা
পাঁচারকারীদের জন্য সিস্টেমের কোনো অভাব নেই।
ব্যাংকগুলো
ফাঁপা, শূন্য। পৃথিবীতে এমন দেশ আর কয়টা আছে, যে দেশের সরকার আইন করে ব্যাংকগুলোকে
অর্থশূন্য করে দেউলিয়া হবার সুযোগ দেয়? বাংলাদেশ দিয়েছে। আপনার দশলাখ টাকা যে ব্যাংকে
আছে, সেই ব্যাংক যদি আগামীকাল দেউলিয়া হয়ে যায়, তবে আপনি সর্বোচ্চ একলাখ টাকা ক্ষতিপূরণ
পাবেন। আপনার এক কোটি টাকা মাইর গেলেও আপনি এক লাখ টাকাই পাবেন, একটাকাও বেশি নয়। এটাই
বাংলাদেশের আইন।
হেনরি কিসিঞ্জারের ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’র আজও কোনো তলা নেই। বেহুদা লম্বা লম্বা কথা বলে তো কোনো লাভ নেই, বরং কথা বলার আগে প্যারিস কিংবা মন্ট্রিয়ল কিংবা মিউনিখে গিয়ে নিজের জানের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে তবেই কথা বলা উচিত। নয়তো মোশতাক আহমেদের দশা যে আমার আপনার হবে না, তার নিশ্চয়তা কী?
৩.
আব্রাহাম লিঙ্কন
তার সন্তানকে পরামর্শ দিয়েছিলেন, উত্তেজিত-উন্মত্ত জনতার সাথে কখনোই না চলতে। বহুদিন
পেরিয়ে গেছে, আমি এখনো আওয়ামীলীগ-বিএনপি কিংবা ধর্মীয় জনতার মিছিল দেখলে তফাতে সরে
যাই। যে মানুষেরা কোরানশরীফের দোকান ভেঙে দিতে পারে, যে মানুষেরা ওস্তাদ আলাউদ্দীন
খাঁর জাদুঘর ভেঙে দিতে পারে, যে অমানুষের পাল প্রকাশ্য রাজপথে বিশ্বজিতকে কুপাতে পারে,
সরাইলের হিন্দুপল্লী আগুনে ছারখার করে দিতে পারে, সেই রাজনৈতিক বিশ্বাস আমার নয়, সেই
ধর্মীয় উন্মত্ততাকে আমি ঘেন্না করি।
এবং অবশ্যই,
আমার জন্মভূমিকে যারা তলাবিহীন ঝুড়িতে পরিণত করেছে তাদের প্রতিও অপরিসীম ঘৃণা। বুকের
একদম গভীর থেকে একদলা থুথু তাদের জন্য।
আমার আহ্বান
থাকবে, এই সরকারের প্রতিটা মনুষ্যসন্তানের প্রতি, আপনারা দেশের জন্য কাজ করছেন, আরো
কঠোর হোন। আপনাদের আশেপাশেই এতো এতো ঠগ-জোচ্চোরের বসবাস, এতো এতো লোভী অমানুষের বসবাস,
এদেরকে নিয়ন্ত্রণ করুন। জনগণকে আইন মানতে বাধ্য করার আগে আপনাদের মধ্যকার এই শোষকদেরকে
থামান। সরকারি কর্মচারিদের বেতনভাতা দ্বিগুণ-তিনগুণ বাড়িয়েও এদেরকে নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে
না। কুকুরের মুখে খাবার দিয়ে যদি তাকে পোষ মানানো না যায়, তবে হাতে লাঠি নিতে হয়।
দুর্নীতি, আইন
অমান্য করার প্রবণতা নিশ্চিহ্ন করার এখন একটাই উপায়, খড়গহস্ত হওয়া। আমজনতা আইন মানবে,
মানতে বাধ্য হবে। আমরাও ছুটবো না কোনো ব্ল্যাকমার্কেটারের কাছে। জনগণের ভেতরে মুক্তিযুদ্ধের
চেতনা সত্যিকার অর্থেই জাগিয়ে তুলতে হলে লঘুপাপে গুরুদণ্ড আর গুরুপাপে লঘুদণ্ডের রাজনৈতিক-ব্যবসায়িক
হীনম্মন্যতা বন্ধ করা উচিত।
স্বাধীনতার রজতজয়ন্তীর এই বছরেও যদি বাংলাদেশ এই অপরিসীম দুর্নীতিগ্রস্ততা থেকে বেরুতে না পারে, তবে এরচে‘ বড় লজ্জার আর কিছু হতে পারে না।
No comments: