জীবক কুমার ভচ্চ |
সেই আবর্জনার স্তুপ থেকে এক ব্যক্তি শিশুটিকে কুড়িয়ে নিজ গৃহে নিয়ে গেলেন। মরার জন্য ফেলে দেওয়া হলেও মরেনি, এজন্য তিনি তার নাম দিলেন- জীবক। একসময় যুবক হয়ে উঠলো জীবক। অসাধারণ মেধা, তীক্ষ্ণবুদ্ধি আর কঠোর পরিশ্রমের ফলে অল্পবয়সেই মগধের শিক্ষা তার সমাপ্ত হয়ে গেলো। এখন কোথায় শিক্ষা নিতে যাবে জীবক?
তখনকার পৃথিবীতে বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয় ছিলো তক্ষশীলা। এখন যেমন ইংল্যান্ডের ক্যামব্রিজ, অক্সফোর্ড, তখন সেইরকম সুনাম ছিলো তক্ষশীলার। সুদূর চীন, মালয় দ্বীপাঞ্চল থেকে ছাত্ররা এখানে পড়তে আসতো। কিন্তু তক্ষশীলায় শিক্ষা নিতে যাওয়ার ব্যয় কম ছিলো না। ছাত্রদের নিজ খরচে সেখানে থাকতে হতো। তার উপর জীবকের স্বপ্ন চিকিৎসক হবার। তখন তক্ষশীলা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেরা চিকিৎসাবিজ্ঞানী ছিলেন মহামতি আত্রেয়। তিনি ছিলেন নাক উঁচু মানুষ। বড়ো অঙ্কের গুরুদক্ষিণা তাকে দিতে হতো। জীবকের স্বপ্ন আত্রেয়র কাছে চিকিৎসাবিদ্যা শিখবেন। কিন্তু আত্রেয়কে কি দিয়ে তিনি খুশি করবেন? কিভাবে চলবে তার শিক্ষাজীবন?
নিজের জীবন নিয়ে একটা খেলা খেললেন জীবক। যদি লাইগা যায় টাইপের খেলা। রওয়ানা দিলেন তক্ষশীলায়। গুরু আত্রেয়র দরবারে গিয়ে আভূমি নত হয়ে পদধূলি নিলেন। আত্রেয়র শিষ্য হবার বাসনা ব্যক্ত করলেন। আত্রেয় বললেন, ‘তা বাপু, তোমাকে যে আমি শেখাবো, গুরুদক্ষিণা কী এনেছো দেখাও।’
জীবক বললেন, ‘গুরু, এই জীবকের আপাদমস্তক আপনার গুরুদক্ষিণা, আপনার ক্রীতদাস হয়ে সে জীবন কাটাবে।’
জীবক এই তরুণের বুদ্ধিদীপ্ত উত্তর আর তার দুই চোখের ঔজ্জ্বল্য দেখে হেসে ফেললেন। বললেন, ‘ঠিক আছে, তুমি আজ থেকে আমার এখানে থাকবে।’
ঠিক সাত বছর আত্রেয়র সান্নিধ্যে ছিলেন জীবক। নিজের সবকিছু ঢেলে দিয়ে তিনি গুরুর সেবা আর অধ্যয়ন চালিয়ে যান। আত্রেয় সন্তুষ্ট ছিলেন তার ওপর। শিক্ষা সমাপ্ত হয়ে গেলে তিনি জীবককে বললেন, ‘জীবক, আমার একটি গাছের পাতা দরকার, যে পাতায় কোনো ঔষধি গুণ নেই। তুমি আমাকে সেই গাছের পাতা এনে দাও।’
গুরুর নির্দেশ পেয়ে জীবক সেরকম একটি গাছের পাতার সন্ধানে বেরুলেন। তক্ষশীলার পাশে তখন ছিলো বিশালাকৃতির বন। জীবক ছয় মাস সেখানে গাছের পর গাছ, পাতার পর পাতা খুঁজে বেড়ালেন, পরীক্ষা করলেন একটার পর একটা। কঠোর পরিশ্রম আর না খাওয়া না নাওয়া, অযত্নে শরীর শুকিয়ে কাঠ। চুল-দাড়ি-গোফ লম্বা হয়ে জীবক হয়ে গেলেন আস্ত এক জংলী।
গুরু কিছু শিষ্যকে পাঠালেন জীবককে খুঁজে বের করতে। তাকে ধরে তক্ষশীলায় নিয়ে আসার নির্দেশ দিলেন তিনি। বহু খোঁজাখুঁজি করে তারা বের করলো জীবককে। জীবক তখনো গুরুর নির্দেশ পালনের নেশায়, কাঙ্ক্ষিত পাতা তাকে খুঁজে পেতেই হবে। সতীর্থরা বললেন, ‘চলো জীবক, তক্ষশীলায় চলো।’ কিন্তু জীবকের কাজ তো শেষ হয়নি, তিনি ফিরে যাবেন কী করে? সতীর্থ বন্ধুরা বললেন, ‘গুরু তোমাকে নিয়ে যেতে বলেছেন।’ গুরুর ডাকে নতমস্তকে তক্ষশীলায় গিয়ে হাজির হলেন জীবক। চোখে-মুখে তার ব্যর্থতার চিহ্ন। আত্রেয় হেসে জিজ্ঞেস করলেন, ‘পাতা খুঁজে পেয়েছো জীবক।’ মাথা মাটির দিকে দিয়ে জীবক নিজের অপারগতা প্রকাশ করলেন। ‘না, তিনি সেই কাঙ্ক্ষিত পাতা খুঁজে পাননি।’ গুরু জড়িয়ে ধরলেন তার সবচেয়ে মেধাবী ছাত্রটিকে। বললেন, ‘পুত্র আমার, তুমিই সফল। আমার আর কোনো ছাত্র পারেনি এই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে। সবাই একটা না একটা পাতা নিয়ে আসতো যেটাতে ঔষধি গুণ নেই। অথচ ধরাধামের প্রত্যেকটা উদ্ভিদ সৃষ্টির কল্যাণে সৃষ্ট হয়েছে।’
জীবককে দেওয়া হলো চিকিৎসকের সনদপত্র। জন্মভূমির দিকে ফিরে চললেন জীবক। পথে পথে মানুষের দূরারোগ্য রোগের চিকিৎসা তিনি করে যেতে থাকলেন। মগধে পৌঁছাবার পূর্বেই তার নাম-ডাক ছড়িয়ে পড়লো সারা ভারতবর্ষে। মগধের রাজচিকিৎসক হিসেবে নিয়োগ পেলেন পৌঁছামাত্রই। জীবকের জীবনের বড়ো পাওয়া ছিলো মহামতি বুদ্ধের চিকিৎসা করা। ইতিহাস তাকে চেনে সর্বকালের সেরা একজন চিকিৎসক ছিলেন জীবক কোমার ভচ্চ নামে।
গুরুদক্ষিণা
Reviewed by আহমাদ সালেহ
on
January 06, 2019
Rating:
No comments: